সোমবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১

আত্নকথন - বাবা-দিবস ২০২১

অনেক বছর আগে , আমি ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়তাম, ভোর বেলায় (প্রায় সকাল ৫ঃ৩০টার দিকে) আব্বা আমাকে আর বড়-আপাকে নিয়ে হাটতে বের হতো। তার আগে আব্বা নামাজ পড়ে নিতো, আগের রাতের চিরতা পানিতে ভিজিয়ে রাখা রস সকাল বেলায় খেয়ে নিতে হতো (যদিও ব্যপারটা মোটেই সুখকর ছিল না)। আমরা এয়ারপোর্ট রোডের পাশ দিয়ে, নতুন বানানো স্বাধীনতা ফোয়ারা দেখতে দেখতে, লাল দিঘীর মাঠ ঘেসে (যেটা এখন নভো থিয়েটার) চন্দ্রিমা উদ্দানের দিকে যেতাম। আর আমি দিতাম দৌড়, আব্বা আর বড়-আপার সাথে হাটতে একঘেয়ে লাগতো, তার থেকে দৌড় দিয়ে জিয়ার কবরের পাশের ঢালু অংশটা ঘেসে উপরে উঠতাম, কখনও সেখানে পৌছে শুয়ে থাকতাম আর আপেক্ষা করতাম আব্বার পৌছানো পর্যন্ত। 
 
এই সময়টাতে আমার কাছে জীবন ছিল সাদামাটা, সকালে ঘুম থেকে উঠো, আব্বার সাথে প্রাতঃভ্রমন, বাসায় এসে স্কুলে যাওয়ার আগে একটু পড়া, ১০ টার দিকে স্কুল, বিকেলে বাসায় আসা, আর মাঝে মধ্যে বাসার সামনের মাঠে খেলতে যাওয়া। খেলা ধূলায় আমার অনীহা ছিল না, কিন্তু আমার বাসার সবার ধারনা ছিল, আমি নাকি চিন্তা ভাবনা করে বলে লাথি দিতাম। 
 
বিকেলের দিকে আরেকটা ব্যাপার দেখতাম আব্বা সারাদিন অফিস শেষে মনের আনন্দে বাগানের পরিচর্যা করছে - এত আনন্দ নিয়ে কেউ বাগান করে এটা দেখাটাও একটা আনন্দ। আব্বার বাগানে হরেক রকমের গোলাপ ছিল, ক্যাক্টাস ছিল, বাসার গেটের সামনে ছিল বেলি ফুল, হাসনা হেনা। গোল্ডের শাওয়ারের একটা গাছ প্রতি বসন্তে আগুন ঝলসানো রূপ দেখাতো বাসার গ্রিলের উপর। সকাল বেলায় দেখতাম ঝাঁক বেধে ফুটতো এইট-ও-ক্লক আর নাইন-ও-ক্লক। এমনকি সন্ধ্যায় সামনের বারান্দায় যখন পড়তে বসতাম, কখনও পেতাম বেলী ফুলের সুবাস আবার কখনো হাস্না হেনার মোহ জাগানিয়া আবেশ। 
 
অনেকগুলো সময় হারিয়ে গেলেও স্মৃতি গুলো হারিয়ে যায়নি। আব্বার হাসিমাখা চেহারার সাথে, আনন্দ মিশানো অনুভূতি আছে, ভালবাসাময় গুচ্ছ গুচ্ছ স্মৃতি আছে, আর আছে অনাবিল প্রশান্তি। একটা বাবা যখন তার সন্তানদের জীবন থেকে চলে যায়, রেখে যায় স্নৃতিময় মহাকাব্য। এই মহাকাব্য প্রত্যেকটা সন্তানের হৃদয়ে গেথে থাকে শেষকাল পর্যন্ত। এই গত বছরও আব্বাকে হ্যাপি ফাদার্স ডে বলেছিলাম, বলেছিলাম আব্বা করোনার সময়কাল শেষ হলেই চলে আসো আবার মেলবোর্নে - ভিসা তো আছেই। এই বছরও আমি হ্যাপি ফাদার্স ডে বলছি আব্বাকে - "আব্বা যেখানেই থাকো ভাল থাকো, আল্লাহ তোমাকে খুব ভাল রাখুক"। 
 
আমার সন্তানরা আমার জন্য কার্ড বানায়, বঊ খাওয়া বানায়, ভালবাসার মায়া বারবার তৈরী হয় বারবার এই দিনে - আর চেষ্টায় থাকি, আমিও যেন ভালবাসার স্মৃতিময় মহাকাব্য রেখে যেতে পারি সন্তানদের জন্য। সব বাবাদের জন্য রইল ভালবাসা। 
 
#বাবা-দিবস #২০২১

শুক্রবার, ৫ মার্চ, ২০২১

আত্ন-কথন - শুন্যতা

 

শুন্যতা মানে ফাঁকা, অথবা থেকেও নেই। আমাদের চারপাশের সব আছের ভিতরে যখন কিছু হারিয়ে যায়, ঠিক তখনকার অব্যাক্ত অনুভূতিই শূন্যতা। আমরা ছোট্টকালে শূন্য লিখতে শিখি, কিন্তু এই শুন্যের ভেতর জীবনের কত শত শূন্যস্থান আছে তা আত্বস্থ করতে পারি না। জীবনের সবচেয়ে ব্যাপক শূন্যস্থান কোথায়? – মহাশূন্যে নাকি মনে নাকি আত্নায়? আমাদের সবার জন্ম ভালবাসায়, আমরা বড় হই নানা রকম ভালবাসার প্রবাহে, আর সেই সাথে আকড়ে ধরি জীবনের মানুষদের। যখন কোন এক জটিল ক্ষণে যদি এই জীবন-চলনে ব্যাঘাত ঘটে – তবেই কি আমরা শূন্যতা অনুভব করি না?

ছোট্টবেলায় একবার পানিতে ডুবে গিয়েছিলাম, মেঘনা নদীর ঘোলা পানিতেঠিক সে মুহূর্তটা আমার এখনো মনে আছে, তলিয়ে যাচ্ছি কোন এক শুন্যতায়। সে শুন্য ক্ষন আমাকে এখনও মাঝে সাঝে গ্রাস করে।

আমার বাবা শক্ত মনের প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন; দেশ ছেড়ে যখন বিঁভূইয়ে যাত্রা ক্ষনের আগে এয়ারপোর্টে সেই বাবার চোখ মুছতে দেখার সময়টাতে - আমার মধ্যে অজানা শূন্যতা তৈরী করেছিল। মন বলছিল কেন অযথাই শুন্যতা তৈরী করছিস ছেড়ে চলে অচেনা গন্তব্যে; কিন্তু শূন্যস্থান তৈরীতে ছেদ ঘটাতে পারি নাই।

সিডনি এয়ারপোর্টে প্রথমবারের মতো যখন বিদায় জানালাম দেড় বছড়ের ছেলে ও স্ত্রীকে কয়েক মাসের জন্য – সে সময়টাতেও এলোমেলো শুন্যতায় বুকে হাহাকার উঠেছিল। মনে হয়েছিল আমি শূন্য হয়ে গেছি, আমার সব থেকেও কিছুই নাই।

এই শুন্যতা তৈরীর বছর ২০২০ এ, এই এক জীবনের সবচেয়ে ভিতরের মানুষ আমার আব্বাকে হারানোর রাতে বুকের ভিতরটায় এক ভীষণ কষ্টে ‘থমকে-যাওয়া’ শুন্যতায় আটকে গেছি। এই শূন্যতা আমাকে সারাজীবনের শুন্যস্থান করে দিয়েছে। ভালবাসা-ভরসা-আশ্রয় সব যেন কেড়ে নিয়েছে। আব্বার রুহটা যখন দেহ ছাড়ল, মনে হচ্ছিল আব্বা যেন হাসছে – ভালবাসার প্রাঞ্জল হাসি। আব্বা আমাদের এক বিশাল ভালবাসার শূন্যস্থান দিয়ে চলে গেলেন অজানায়।

ছেলেবেলায় দেখেছি আমার দাদার অসাধারণ হাতের লেখায় একটা খাতা – যেখানে আছে যোগাসন, দোয়া, নীতি কথা, পরিবারের গাছ। আমার কাছে রাখতাম খাতাটা, ভাল লাগতো। মনে হতো দাদাকে দেখি নাই কিন্তু তার হাতের লেখায় তার গোছানে জীবনাচারনের একটা প্রচ্ছায়া পেলাম। বড় হয়ে দেখলাম আব্বাও একই ভাবে ডায়েরীতে লিখে রাখে অনেক কিছু, পরিবারেরে যোগসূত্র, ঔষধের নাম, ফোন নাম্বার, দরকারী কাজ ইত্যাদি। দাদা-আব্বা-আমি-আমার ছেলেরা একটা পরিবারের গাছের শাখা। গাছের ডালের শক্ত প্রান্তটা যেমন মূল গাছের সাথে থাকে, আমার দাদা-বাবারাও তাই – শক্ত করে আমাদের ধরে আছে যাতে আমরা শূন্যতায় হারিয়ে না যাই। 

#আত্নকথন  #শুন্যতা