অনেক বছর আগে , আমি ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়তাম, ভোর বেলায় (প্রায় সকাল ৫ঃ৩০টার দিকে) আব্বা আমাকে আর বড়-আপাকে নিয়ে হাটতে বের হতো। তার আগে আব্বা নামাজ পড়ে নিতো, আগের রাতের চিরতা পানিতে ভিজিয়ে রাখা রস সকাল বেলায় খেয়ে নিতে হতো (যদিও ব্যপারটা মোটেই সুখকর ছিল না)। আমরা এয়ারপোর্ট রোডের পাশ দিয়ে, নতুন বানানো স্বাধীনতা ফোয়ারা দেখতে দেখতে, লাল দিঘীর মাঠ ঘেসে (যেটা এখন নভো থিয়েটার) চন্দ্রিমা উদ্দানের দিকে যেতাম। আর আমি দিতাম দৌড়, আব্বা আর বড়-আপার সাথে হাটতে একঘেয়ে লাগতো, তার থেকে দৌড় দিয়ে জিয়ার কবরের পাশের ঢালু অংশটা ঘেসে উপরে উঠতাম, কখনও সেখানে পৌছে শুয়ে থাকতাম আর আপেক্ষা করতাম আব্বার পৌছানো পর্যন্ত।
এই সময়টাতে আমার কাছে জীবন ছিল সাদামাটা, সকালে ঘুম থেকে উঠো, আব্বার সাথে প্রাতঃভ্রমন, বাসায় এসে স্কুলে যাওয়ার আগে একটু পড়া, ১০ টার দিকে স্কুল, বিকেলে বাসায় আসা, আর মাঝে মধ্যে বাসার সামনের মাঠে খেলতে যাওয়া। খেলা ধূলায় আমার অনীহা ছিল না, কিন্তু আমার বাসার সবার ধারনা ছিল, আমি নাকি চিন্তা ভাবনা করে বলে লাথি দিতাম।
বিকেলের দিকে আরেকটা ব্যাপার দেখতাম আব্বা সারাদিন অফিস শেষে মনের আনন্দে বাগানের পরিচর্যা করছে - এত আনন্দ নিয়ে কেউ বাগান করে এটা দেখাটাও একটা আনন্দ। আব্বার বাগানে হরেক রকমের গোলাপ ছিল, ক্যাক্টাস ছিল, বাসার গেটের সামনে ছিল বেলি ফুল, হাসনা হেনা। গোল্ডের শাওয়ারের একটা গাছ প্রতি বসন্তে আগুন ঝলসানো রূপ দেখাতো বাসার গ্রিলের উপর। সকাল বেলায় দেখতাম ঝাঁক বেধে ফুটতো এইট-ও-ক্লক আর নাইন-ও-ক্লক। এমনকি সন্ধ্যায় সামনের বারান্দায় যখন পড়তে বসতাম, কখনও পেতাম বেলী ফুলের সুবাস আবার কখনো হাস্না হেনার মোহ জাগানিয়া আবেশ।
অনেকগুলো সময় হারিয়ে গেলেও স্মৃতি গুলো হারিয়ে যায়নি। আব্বার হাসিমাখা চেহারার সাথে, আনন্দ মিশানো অনুভূতি আছে, ভালবাসাময় গুচ্ছ গুচ্ছ স্মৃতি আছে, আর আছে অনাবিল প্রশান্তি। একটা বাবা যখন তার সন্তানদের জীবন থেকে চলে যায়, রেখে যায় স্নৃতিময় মহাকাব্য। এই মহাকাব্য প্রত্যেকটা সন্তানের হৃদয়ে গেথে থাকে শেষকাল পর্যন্ত। এই গত বছরও আব্বাকে হ্যাপি ফাদার্স ডে বলেছিলাম, বলেছিলাম আব্বা করোনার সময়কাল শেষ হলেই চলে আসো আবার মেলবোর্নে - ভিসা তো আছেই। এই বছরও আমি হ্যাপি ফাদার্স ডে বলছি আব্বাকে - "আব্বা যেখানেই থাকো ভাল থাকো, আল্লাহ তোমাকে খুব ভাল রাখুক"।
আমার সন্তানরা আমার জন্য কার্ড বানায়, বঊ খাওয়া বানায়, ভালবাসার মায়া বারবার তৈরী হয় বারবার এই দিনে - আর চেষ্টায় থাকি, আমিও যেন ভালবাসার স্মৃতিময় মহাকাব্য রেখে যেতে পারি সন্তানদের জন্য। সব বাবাদের জন্য রইল ভালবাসা।